ভূমিকা
ইসলামে মু’মিনদের জন্য আল্লাহর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য একটি ব্যতিক্রমী ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এখানে আল্লাহর সাথে ব্যবসা বলতে দুনিয়ার জীবন এবং তার সম্পদের প্রকৃতপক্ষে সঠিক বিনিয়োগ বোঝায়। মু’মিনের জীবন শুধু পার্থিব সাফল্যের জন্য নয় বরং আখিরাতের সফলতার জন্যও নিবেদিত। আল্লাহর পথে সম্পদ, সময় এবং শ্রম ব্যয় করে তাঁকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে মু’মিনরা প্রকৃত লাভবান হতে চায়, যা কুরআন ও হাদিসে চিরন্তন সুখের প্রতিশ্রুতি হিসেবে উল্লেখিত।
মু’মিনদের জন্য সুসংবাদ
আল্লাহ্ তা‘আলা মু’মিনদের সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন এবং এর বিনিময়ে তিনি তাদেরকে জান্নাত প্রদান করবেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
((اِنَّ *اللّٰہَ *اشۡتَرٰی مِنَ *الۡمُؤۡمِنِیۡنَ *اَنۡفُسَہُمۡ وَ *اَمۡوَالَہُمۡ بِاَنَّ لَہُمُ *الۡجَنَّۃَ) ؕ (*یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ) (*فَیَقۡتُلُوۡنَ وَ *یُقۡتَلُوۡنَ) ۟ (*وَعۡدًا عَلَیۡہِ *حَقًّا فِی *التَّوۡرٰىۃِ وَ *الۡاِنۡجِیۡلِ وَ *الۡقُرۡاٰنِ) ؕ وَ (مَنۡ اَوۡفٰی *بِعَہۡدِہٖ مِنَ *اللّٰہِ) (*فَسۡتَبۡشِرُوۡا *بِبَیۡعِکُمُ الَّذِیۡ *بَایَعۡتُمۡ بِہٖ) ؕ وَ (ذٰلِکَ ہُوَ *الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ)) ﴿۱۱۱﴾
((নিশ্চয় *আল্লাহ্ *মুমিনদের কাছ থেকে তাদের *জীবন ও *সম্পদ *কিনে নিয়েছেন [এর বিনিময়ে] যে, তাদের জন্য আছে *জান্নাত)। (তারা আল্লাহ্র পথে *ক্বিতাল/যুদ্ধ করে), (অতঃপর তারা *মারে ও *মরে)। (*তাওরাত, *ইনজীল ও *কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের *হাক্ব *ওয়াদা রয়েছে। আর (নিজ *প্রতিজ্ঞা পালনে *আল্লাহর চেয়ে *শ্রেষ্ঠতর কে আছে?) (সুতরাং তোমরা যে *সওদা করেছ সে *সওদার জন্য *আনন্দিত হও))। আর ((সেটাই তো *মহাসাফল্য))। [সূরা আত-তাওবা(০৯):১১১]
কতিপয় বিষয় স্পষ্টীকরণ
আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াতে কতিপয় বিষয় স্পষ্ট করেছেন-
১) তিনি এই ‘ব্যবসা/ক্রয়-বিক্রয়’-এর চুক্তি/অঙ্গিকারকে ‘হাক্ব ওয়াদা’ বলেছেন এবং উত্তম কিতাবসমূহে উল্লেখ করেছেন।
২) তিনি মু’মিনদেরকে জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁর চেয়ে অধিক প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কেউ নেই।
৩) তিনি মু’মিনদেরকে এই ‘হাক্ব ওয়াদা’ পেয়ে খুশী হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে- এটিই হচ্ছে মহাসাফল্য।
সুতরাং জ্ঞানীদের চিন্তা করা উচিৎ। এই ‘হাক্ব ওয়াদা’ ও ‘ক্রয়-বিক্রয়’ কত বিরাট! এখানে-
১) ‘ক্রেতা’ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা।
২) ‘পণ্য’ হচ্ছে ‘মু’মিনদের জান ও মাল’।
৩) ‘বিনিময় মূল্য’ হচ্ছে ‘জান্নাতুন-নাঈম, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর দিদারের স্বাদ’।
৪) ‘যাঁর মাধ্যমে’ এই ‘ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছে তিনি হচ্ছেন ‘আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল এবং বনী আদম ও ফিরিস্তাকুলের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান।
৫) ‘চুক্তিটি লিখিত’ হয়েছে স্বয়ং ‘আল্লাহর কিতাবসমূহে (তাওরাত, ইনজীল ও কুরআন)’।
আল্লাহ তা’আলার পরীক্ষা
আল্লাহর এই ‘হাক্ব ওয়াদা’-এর প্রেক্ষিতে যেহেতু স্বভাবতই সকলে ‘জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মুহাব্বাত’-এর দাবীদার হবে, সেহেতু কার দাবীটি সঠিক তার সত্যতা যাচাই করার জন্য মহান আল্লাহ্ তা‘আলা শর্ত আরোপ করে বললেন-
((وَ *لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ حَتّٰی *نَعۡلَمَ *الۡمُجٰہِدِیۡنَ مِنۡکُمۡ وَ *الصّٰبِرِیۡنَ) ۙ وَ (*نَبۡلُوَا۠ *اَخۡبَارَکُمۡ)) ﴿۳۱﴾
“((আর আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে *পরীক্ষা করব, যতক্ষণ না আমরা *জেনে নেই তোমাদের মধ্যে *জিহাদকারী ও *ধৈর্যশীলদেরকে) এবং (আমরা তোমাদের *অবস্থা/কর্মকান্ড *পরীক্ষা করে নেব)।” [সূরা মুহাম্মাদ(৪৭):৩১]
ঈমানদারগণ ও মুনাফিক্বদের অবস্থা
সুতরাং, যখন বলা হলো- পরীক্ষা করা ছাড়া এ দাবী গ্রহণযোগ্য নয়, তখন যারা [যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে] কেবল কথায়ই আল্লাহর আদেশ ও রাসূলুল্লাহ্-এর সুন্নাতের অনুরণের দাবী করে; কিন্তু “আল্লাহর রাস্তায় জান ও মালের দ্বারা জিহাদ/ক্বিতাল” করতে মোটেই প্রস্তুত নয়, তাদের সকলে স্বভাবতই পিছিয়ে পড়বে। মূলত যারা ‘দুনিয়ার সামান্য স্বাদ ও স্বার্থ’-এর বিনিময়ে ‘স্থায়ী সুখ-শান্তি’কে বিক্রি করে দেয় তাদেরকে মূর্খদের কাতারেই গণ্য করা হয়।
অপরদিকে, পাক্কা-ব্যবসায়ীগণ [ঈমানদারগণ] যখন-
‘ক্রেতা-আল্লাহ’র সুমহান মর্যাদা,
‘মূল্য-জান্নাতুন-নাঈম, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর দিদারের স্বাদ’-এর বিশালতা,
‘চুক্তি সম্পাদনে মধ্যস্থতাকারী-রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’-এর মাহাত্ম্য এবং
‘কিতাব’ (তাওরাত, ইনজীল ও কুরআন); যাতে চুক্তিটি লিখিত আছে, তার মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারবে- তখন তারা ‘পণ্য-মুমিনের জান ও মাল’-এর মর্যাদা ও শান-শওকত সম্পর্কে অবগত হবেই।
তারা বুঝতে সক্ষম হবে যে- এটি এমন পণ্য, যা পৃথিবীর অন্যান্য পণ্যের মত নয় এবং ‘দুনিয়ার সস্তা মূল্য-সীমিত কয়েকটি দিরহাম’-এর বিনিময়ে এমন পণ্যকে বিক্রি করে দেয়া মারাত্মক ক্ষতিকর ও ভুল হবে। কারণ, দুনিয়ার স্বাদ ও সম্পদ ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু পার্থিব জীবনের কৃতকর্মের ফলাফল সুদূর প্রসারী।
‘জান্নাতুন-নাঈম’-এর হকদার
প্রকৃত মুজাহিদগণ; যারা প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহকে এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসে- পরিশেষে তাদের হাতেই এসে ধরা দিবে এই ‘বিনিময় মূল্য’ তথা ‘জান্নাতুন-নাঈম’, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর দিদারের স্বাদ। কুর’আনে তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-
((یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَنۡ *یَّرۡتَدَّ مِنۡکُمۡ عَنۡ *دِیۡنِہٖ) (فَسَوۡفَ *یَاۡتِی اللّٰہُ *بِقَوۡمٍ) (*یُّحِبُّہُمۡ وَ *یُحِبُّوۡنَہٗۤ) ۙ (*اَذِلَّۃٍ عَلَی *الۡمُؤۡمِنِیۡنَ *اَعِزَّۃٍ عَلَی *الۡکٰفِرِیۡنَ) ۫ (*یُجَاہِدُوۡنَ فِیۡ *سَبِیۡلِ اللّٰہِ) وَ (لَا *یَخَافُوۡنَ *لَوۡمَۃَ *لَآئِمٍ) ؕ (ذٰلِکَ *فَضۡلُ اللّٰہِ *یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ *یَّشَآءُ) ؕ وَ (اللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ)) ﴿۵۴﴾
“((হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ *দ্বীন থেকে *ফিরে গেলে) (নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক *সম্প্রদায় *আনবেন) (যাদেরকে *তিনি ভালবাসবেন এবং যারা *তাঁকে ভালবাসবে); (তারা *মুমিনদের প্রতি *কোমল ও *কাফেরদের প্রতি *কঠোর হবে); (তারা *আল্লাহর পথে *জিহাদ করবে) এবং (কোন *নিন্দুকের *নিন্দার *ভয় করবে না); (এটা আল্লাহর *অনুগ্রহ, যাকে *ইচ্ছে তাকে তিনি তা *দান করেন) এবং (আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ))।”
[সূরা আল-মায়িদাহ(০৫):৫৪]
উপসংহার
আল্লাহর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য এমন একটি চুক্তি যা নির্দিষ্ট লাভের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। পার্থিব জীবনের সকল সম্পদ, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা আল্লাহর পথে ব্যয় করে আখিরাতে শাশ্বত শান্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা মু’মিনদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এতে করে মু’মিনেরা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পান। আল্লাহর সাথে এই ব্যবসা-বাণিজ্য দুনিয়াতে শান্তি ও প্রজ্ঞা এনে দেয় এবং আখিরাতে চিরস্থায়ী মুক্তির পথ তৈরি করে।